বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) আর দুর্নীতি এই দুটি যেন অভিন্ন সূত্রে গাঁথা। বিআরটিএ’র চেয়ার-টেবিলও দুর্নীতির ভাগিদার! সংস্থাটির বিভিন্ন কর্মকর্তা দুর্নীতির মাধ্যমে কেবল অর্থ লুটপাট করেছেন, তা নয়। দুর্নীতির প্রমাণ ঢাকতে গায়েব করে ফেলেছেন সরকারি নথিও। ২০১১ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে বিআরটিএ’তে নথি গায়েবের অপরাধে ২৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আসামি করে ১১টি মামলা করা করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন। তবে দৃশ্যমান কোন শাস্তির ব্যবস্থা না থাকায় সরকারী নথি গায়েবের মতো ঘটনা বিআরটিএ থেকে বন্ধ করা যাচ্ছে না। চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারী বিআরটিএ’র নরসিংদী সার্কেলে এমন ভয়াবহ একটি নথি গায়েবের ঘটনা ঘটলেও তেমন কোন টনক নড়ছেনা সংস্থাটির। বহাল তবিয়তে আছেন সংস্থাটির নরসিংদী সার্কেলের সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিঃ) শেখ ইমরান, মোটরযান পরিদর্শক রাসেল আহমেদ ও উচ্চমান সহকারী মো. শফিকুল ইসলাম ভূঞা।
সূত্র বলছে, নরসিংদী বিআরটিএ থেকে চলতি বছরের জানুয়ারী মাসে অপেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স এর ৬৮ টি ভলিউম ও পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স এর ২৭ টি ভলিউম সংস্থাটির কার্যালয়ের রেকর্ড রুম থেকে গায়েব হয়ে যায়। পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স এর ভলিউম নম্বর, ৩৬, ৪১, ৪৮, ৫৮, ৭২, ১০১, ১০৬, ১১৬, ১১৭, ১২৩, ১২৫, ১২৬, ১২৭ এই ১৩ টি ভলিউম ছিল ম্যানুয়েল ড্রাইভিং লাইসেন্স ভলিউম। এইসব ভলিউমে ৩৬ নং ভলিউমে NDC5876 থেকে NDC6070 পর্যন্ত ১৯৪ টি ড্রাইভিং লাইসেন্স এর তথ্য ছিল, ৪১ নং ভলিউমে NDC6854 থেকে NDC7052 পর্যন্ত ১৯৮ টি, ৪৮ নং ভলিউমে NDC8228 থেকে NDC8421 পর্যন্ত ১৯৩ টি, ৫৮ নং ভলিউমে NDC10255 থেকে NDC10465 পর্যন্ত ২১০ টি, ৭২ নং ভলিউমে NDC13010 থেকে NDC13213 পর্যন্ত ২০৩ টি, ১০৬ নং ভলিউমে NDC19770 থেকে NDC19958 পর্যন্ত ১৮৮ টি, ১১৬ নং ভলিউমে NDC21701 থেকে NDC21896 পর্যন্ত ১৯৫ টি, ১১৭ নং ভলিউমে NDC21897 থেকে NDC22093পর্যন্ত ১৯৬ টি, ১২৩ নং ভলিউমে NDC23084 থেকে NDC23277 পর্যন্ত ১৯৩ টি, ১২৫ নং ভলিউমে NDC23474 থেকে NDC23672 পর্যন্ত ১৯৮ টি, ১২৬ নং ভলিউমে NDC23673 থেকে NDC23868 পর্যন্ত ১৯৫ টি, ১২৭ নং ভলিউমে NDC23869 থেকে NDC23909 পর্যন্ত ৪০ টি সর্বমোট ১৩ টি ম্যানুয়াল পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স ভলিউমে ২২০৩ জন পেশাদার চালকের লাইসেন্স সংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষিত ছিল। এছাড়াও ২০২২ সালের ৫ টি ভলিউমে NRD22001P001, NRD22002P001, NRD22003P001, NRD22004P001, NRD22005P001 উক্ত সিরিয়ালের ১০০০ জন পেশাদার চালকের তথ্য ছিল। ২০২৩ সালের ১০ টি ভলিউমে NRD23001P001, NRD23002P001, NRD23003P001, NRD23004P001, NRD23005P001, NRD23006P001, NRD23007P001, NRD23008P001, NRD23009P001, NRD230010P001 উক্ত সিরিয়ালের ২০০০ জন পেশাদার চালকের তথ্য ছিল। ২০২২ ও ২০২৩ সালের যে সকল ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছে সেগুলোর তথ্য বিআরটিএ’র আইএস সফটওয়্যারে সংরক্ষিত আছে। ফলে পুনরায় ভলিউম তৈরা করা যেতে পারে। তবে ম্যানুয়াল ডাটার ভলিউমের ২২০৩ জন পেশাদার চালকের ভবিষ্যৎ অন্ধকারের দিকে চলে গিয়েছে।
এছাড়াও অপেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স এর ভলিউম নম্বর ১১, ১৯, ২৩, ২৪, ২৫, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯, ৩০, ৩২, ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪৩, ৪৪, ৪৫, ৪৬, ৪৭, ৪৮, ৫০, ৫২, ৫৩, ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৮, ৫৯, ৬০, ৬১, ৬২, ৬৩, ৬৪, ৬৬, ৬৮, ৬৯, ৭০, ৭১, ৭২, ৭৩, ৭৪, ৭৫, ৭৬, ৭৭, ৭৮, ৮০, ৮২, ৮৩, ৮৫, ৮৬, ৮৭, ৮৮, ৮৯, ৯০, ৯১, ৯২ মোট ৫৭ টি ভলিউমে প্রায় ১১৪০০ টি অপেশাদার চালকের তথ্য ছিল। এবং এগুলো ম্যানুয়াল ড্রাইভিং লাইসেন্স হওয়ায় এগুলোর নথি পুনরায় রিকভারি করাও সম্ভব হবে না বলে নিশ্চিত করেছেন বিআরটিএ’র বিভিন্ন সার্কেলের কর্মকর্তারা।
শুধুমাত্র অপেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স এর ২০২২ সালের অনলাইন ভলিউম নং-০১, ০২, ০৪, ০৫, ০৭, ২০২৩ সালের ভলিউম নং-০২, ০৬, ০৭, ১০, ১১, ১২ নং ভলিউমের তথ্য পুনরায় বিআরটিএ’র আইএস থেকে নিয়ে পুনরায় ভলিউম তৈরি করতে পারবে।
বিষয়টি ধামাচাপা দিতে আদালতকে ব্যবহার করছে বিআরটিএঃ গত ২৮ জানুয়ারী নরসিংদী বিআরটিএ’র উচ্চমান সহকারী/কম্পিউটার অপারেটর মো. শফিকুল ইসলাম ভুঞা নরসিংদী মডেল থানায় ৪৫৭ ও ৩৮০ পেনাল কোডের ধারায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলা নং-২১/২১ তারিখ-২৮ জানুয়ারী ২০২৪। বর্তমানে মামলাটি নরসিংদী অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালাতের বিচারাধীন রয়েছে।
তবে এই বিষয়ে বিভাগীয় তদন্তের জন্য সংস্থাটির চেয়ারম্যান ঢাকা বিভাগীয় উপপরিচালক (ইঞ্জিঃ) স্বদেশ কুমার দাসকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তিনি তদন্ত করে চলতি মাসের ১২ তারিখে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছেন।
ঢাকা বিভাগীয় উপপরিচালক (ইঞ্জিঃ) স্বদেশ কুমার দাস বলেন, আমরা বিষয়টি তদন্ত করেছি। তবে আদালতে মামলা চলমান আছে, এই বিষয়ে ইতিমধ্যে পুলিশ তদন্ত প্রতিবেদন প্রদান করেছে। তদন্তে কাউকে অভিযুক্ত করা হয়নি। মামলা চলমান থাকায় আমরা এই বিষয়ে প্রাথমিক তদন্ত করে আমাদের কিছু সুপারিশ প্রদান করেছি। তবে কর্তৃপক্ষ চাইলে বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশনের নজরে এনে পুনরায় তদন্ত করতে পারে।
মামলার বাদী নরসিংদী বিআরটিএ’র উচ্চমান সহকারী/কম্পিউটার অপারেটর মো. শফিকুল ইসলাম ভুঞা বলেন, নরসিংদী সার্কেলের ০১ নং রুমে ড্রাইভিং লাইসেন্স এর ভলিউম গুলো সংরক্ষিত থাকে। গত ২৫ জানুয়ারী সকাল ৮.৪৫ মিনিটে আমি অফিসে এস দেখিতে পাই উক্ত রুমে কিছু ভলিউম কম আছে। বিষয়টি আমি সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিঃ) স্যারকে অবগত করি। তিনি আমাকে ভলিউম গুলোর খোঁজার জন্য নির্দেশ দেন। পরে ২৭ জানুয়ারী অফিসে এসে দেখতে পাই ১ টি বস্তার ভিতর ১০/১২ টি ভলিউম ভরা, খালি ৩ টি বস্তা অফিসে রাখা এবং রেকর্ড রুমের সিলিং ভাঙ্গা। পরবর্তীতে খোঁজ করে দেখি প্রায় শতাধিক ভলিউম অফিস থেকে চুরি হয়ে গেছে।
তবে শফিকুল ইসলামের কথা অনুযায়ী ২৫ জানুয়ারী বেশ কিছু ভলিউম কম ছিল , কিন্তু ২৫ তারিখ রেকর্ড রুমের কোন দরজা জানালা অথবা ছাদ ভাঙ্গা ছিলনা। তাহলে ভলিউম কিভাবে কমলো সেই বিষয়ে স্পষ্ট কোন বক্তব্য নেই তার কাছে।
নরসিংদী মডেল থানার সাব-ইন্সপেক্টর (নিরস্ত্র) আঃ গাফফার তদন্ত প্রতিবেদনে মো. শুক্কুর আলী, মো. সাদেকুর রহমান, মোস্তফা কামাল, নাঈম, মো. শাহীন, আরিফ, মাহবুব ও আহসান নামে ৮ জনকে সন্দেহের কারণে উক্ত মামলায় আটক করেন। কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদনে এই ব্যক্তিগণ প্রকৃত আসামী না বলে উল্লেখ করে গত ২৫ এপ্রিল মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করেন।
বিআরটিএ’তে দুর্নীতির চিত্র দেখে মাথায় হাত পড়েছে যেনো দুদকের অনুসন্ধান দলের! প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারী ও দালাল চক্রের অবৈধ সম্পত্তির বিবরণ জেনে হতবাক খোদ দুদক। চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী থেকে শুরু করে বড় কর্মকর্তারাও দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে দুর্নীতির আঁখড়া বানিয়েছেন বিআরটিএ’কে। সরকারকে রাজস্ব বঞ্চিত করে নিজেদের পকেট ভারি করেছেন বিআরটিএ’র সংঘবদ্ধ চক্র।
ড্রাইভিং লাইসেন্স এর ভলিউম ছাড়াও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি গায়েব হয়েছে নরসিংদী বিআরটিএ থেকে। এর আগেও বিআরটিএ’তে গায়েব হয়ে যাওয়া নথির অনুসন্ধান করে দুদক নথি গায়েবের ঘটনায় সংস্থাটির দেড় ডজন কর্মকর্তার জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
দুদক সূত্র জানায়, নারায়ণগঞ্জ সার্কেল অফিস থেকে ২০০২-০৫ সালে ২১ হাজার ৮০৬টি ড্রাইভিং লাইসেন্সের নথি গায়েব করেছেন তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী পরিচালক কাজী মাহবুবুর রহমান। এর আগে ২০০১-০৭ সালে ঢাকা দক্ষিণের ইকুরিয়া অফিস থেকে ১ হাজার ৬৪৪টি রেজিস্ট্রেশনের নথি উধাও করেন ১০ জন।
তদন্তে জানা গেছে, উভয় ঘটনায় কর ও ফি এর টাকা গ্রহণ করে সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করা হয়েছে। পরে কিছু নথি পাওয়া গেলেও এখনো ১ হাজার ৫৭১টির হদিস মেলেনি।
এ ছাড়া ২০০৩ সালের আগে পাবনা অফিস থেকে রেজিস্ট্রেশন ও লাইসেন্সের কর ও ফি এর ২০ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করেছেন বর্তমানে সদর কার্যালয়ে কর্মরত পরিচালক (ইঞ্জিঃ) শীতাংশু শেখর বিশ্বাস এবং ঝিনাইদহ সার্কেলের সাবেক সহকারী পরিচালক মৃত বিলাস সরকার।
দুদক জানায়, যানবাহন রেজিস্ট্রেশন, নবায়ন, ড্রাইভিং লাইসেন্স, ফিটনেস, রুট পারমিটসহ নানা ক্ষেত্রে দুর্নীতির কারণে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আত্মসাৎকৃত অর্থ চলে গেছে বিআরটিএ সংশ্লিষ্ট অসাধু কর্মকর্তাদের পকেটে।
এদিকে ২০১৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর বিআরটিএর কেরানীগঞ্জের ইকুরিয়া কার্যালয়ে গণশুনানিতে সিএনজি-অটোরিকশা মালিক সমিতির নেতা নাজমুল হাসান অভিযোগ করেন, তাঁর একটি ‘ডাবল চেসিস’ গাড়ির ফিটনেসের জন্য আবেদন করেছিলেন। দীর্ঘদিন পরও তিনি ফিটনেস সনদ পাননি। পরে বিআরটিএর কার্যালয়ে গিয়ে জানতে পারেন তাঁর গাড়ির নথি গায়েব হয়ে গেছে। বিআরটিএ’র কর্মকর্তা নথি খুঁজে পাচ্ছেন না। শুনানিতে উপস্থিত বিআরটিএ’র তৎকালিন চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম তাৎক্ষণিকভাবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে ডেকে তাঁর ওই সমস্যার সমাধান করেন।
অন্যদিকে আইনি বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও ২০১৯ সালে করদাতার পরিচিতি নম্বর ব্যবহার না করে ও ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে বিএমডব্লিউ, অডি, জাগুয়ারসহ বিভিন্ন দামি ব্র্যান্ডের গাড়ি আমদানিকারক থেকে শুরু করে বিআরটিএ’র কর্মকর্তা-দালালদের তৈরি করা চক্রের মাধ্যমে এই নিবন্ধনপ্রক্রিয়া চলে। দফায় দফায় চিঠি দেওয়ার পরও বিআরটিএ এ ধরনের বিলাসবহুল গাড়ির তালিকা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআরের কাছে দিতে চায়নি। সর্বশেষ আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললে বিআরটিএ ৮৯১টি বিলাসবহুল গাড়ির তালিকা এনবিআরকে দিয়েছে। তালিকায় ২৫৭টি গাড়ির নিবন্ধনই দেওয়া হয়েছে করদাতার পরিচিতি নম্বর ছাড়া। এসব গাড়ির দাম এক কোটি থেকে ১০ কোটি বা এর চেয়েও বেশি। এভাবে বারবার বিআরটিএ থেকে নথি গায়েব হলেও দৃশ্যমান কোন শাস্তির ব্যবস্থা নেই বিআরটিএ’তে।